নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস (ইয়াসমিন হত্যা দিবস) উপলক্ষে মানববন্ধন-সমাবেশ-মিছিল অনুষ্ঠিত
ঘরে বাইরে সর্বত্র নারীর উপর শারীরিক-মানসিক নির্যাতন বন্ধ এবং
তনু-মিতু-আফসানাসহ নারী-শিশু হত্যার দ্রুত বিচার দাবিসমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম এর উদ্যোগে ২৪ আগস্ট বুধবার নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস (ইয়াসমিন হত্যা দিবস) উপলক্ষে ঘরে বাইরে সর্বত্র নারীর উপর শারীরিক-মানসিক নির্যাতন বন্ধ করা এবং তনু-মিতু-আফসানাসহ নারী-শিশু হত্যার বিচারের দাবিতে সকাল ১১ টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন-সমাবেশ ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম ঢাকা নগর শাখার সভাপতি শম্পা বসু। সভায় বক্তব্য রাখেন সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম-এর কেন্দ্রীয় সভাপতি রওশন আরা রুশো, উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য সামসুন্নাহার জ্যোৎস্না, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ এর ঢাকা নগর শাখার সদস্য সচিব জুলফিকার আলী, সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম এর ঢাকা নগর শাখার সদস্য রুখসানা আফরোজ আশা, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট ঢাকা নগর শাখার সাধারণ সম্পাদক মুক্তা বাড়ৈ প্রমূখ।
বক্তারা বলেন, ১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট ঢাকা থেকে বাড়ি ফেরার পথে পুলিশ কর্তৃক ধর্ষিত ও নিহত হয়েছিল দিনাজপুরের ইয়াসমিন। এর বিরুদ্ধে দিনাজপুরসহ সারাদেশে গড়ে উঠা প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ আন্দোলনের স্মরণে প্রতিবছর ২৪ আগস্ট পালিত হয় নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস। ৭ জন সংগ্রামী মানুষের জীবনের বিনিময়ে এবং দেশের সর্বস্তরের মানুষ, সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামসহ বামপ্রগতিশীল নারী সংগঠনসমূহ, রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের আন্দোলনের মুখে ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার বিচার কার্যকর হয়। এরপর কেটে গেছে ২১ বছর। নারী নির্যাতন-ধর্ষণ-হত্যা তো কমেইনি বরং ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ধর্ষণ, গণধর্ষণ, পিটিয়ে হত্যা, যৌতুকের কারণে হত্যা, এসিডে ঝলসে দেয়া, ইন্টারনেটে ছবি ছড়িয়ে ব্ল্যাকমেইল করাÑইত্যাদি নির্যাতনের ধরণ বেড়েছে, দীর্ঘ হয়েছে নির্যাতিতদের মিছিল। ছয় বছরের শিশু থেকে ষাট বছরের বৃদ্ধা, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-দরিদ্র, সমতল বা পাহাড়ের আদিবাসী, সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু কেউই রেহাই পাচ্ছেন না। ঘরে-বাইরে, পথে-ঘাটে, কর্মক্ষেত্রে সর্বত্রই শারিরীক-মানসিকভাবে চলছে এই নির্যাতন।নেতৃবৃন্দ বলেন, নিরাপত্তা বেষ্টিত এলাকা যেখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশ সংরক্ষিত সেই ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় তনুর লাশ পাওয়া গেল। ৫ মাস হয়ে গেল এখনও খুনি গ্রেফতার পর্যন্ত হলো না! এদেশে অন্যায়কারীরা-নিপীড়করা যা খুশি তাই করতে পারে। নিপীড়ক যত ক্ষমতাধর এবং টাকাওয়ালা; বিচার প্রাপ্তি তত কঠিন। বাংলাদেশে বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি চলছে। ধারাবাহিক ভাবে চলছে একের পর এক নারী নির্যাতনের ঘটনা এবং একের পর এক এর বিচারহীনতার কাহিনী। একটি নির্যাতনের ঘটনা বিভৎসতায়, বর্বরতায় আগেরটিকে ছাপিয়ে যায়। বর্ষবরণে নারী নির্যাতনের প্রায় দেড় বছর হতে চললো। চার স্তরের নিরাপত্তা, সিসি ক্যামেরা, ইন্টারনেটে অপরাধীদের ছবিÑকত কথা শুনলাম আমরা তারপরও বিচার আলোর মুখ দেখেনি। পুলিশের আইজি অপরাধীদের দুষ্টু ছেলে বলে মৃদু তিরস্কার করে দিয়েছেন। এবার তনু হত্যার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, দেশে এক-দুইটা ধর্ষণের ঘটনা ঘটলেই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ বোঝায় না! বিচার না হওয়ার কারণে নির্যাতকরা বেপরওয়া হয়ে উঠছে। আফসানা হত্যার পরও আমরা সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে পাচ্ছি। নাম-পরিচয় জানা অপরাধী এখনও গ্রেফতারই হয়নি। ব্রাকের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছেÑএক বছরে নারী নির্যাতন বেড়েছে ৭৪% এবং গণধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে ১৪ শতাংশ। বাংলাদেশ পুলিশের ওয়েবসাইট অনুযায়ী ২০১০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা ছিল ১৭ হাজার ৭৫২। ২০১৫ সালে মামলার সংখ্যা ছিল ২১ হাজার ২২০। এই পরিসংখ্যান প্রকৃতপক্ষে আরও বেশি। কারণ আমরা জানি, সামাজিক কারণে সারাদেশে অসংখ্য নির্যাতনের কোন মামলাই হয় না। ক্ষতিগ্রস্তদের অনেকেই নির্যাতনের পর পুনরায় মানহানির ও হয়রানির ভয়ে এগুতে চায় না। আর বিচার প্রাপ্তি? মাত্র ১ শতাংশ!
সমাবেশে বক্তারা বলেন, একদিকে পুঁজিবাদী আর্থ সামাজিক ব্যবস্থায় নারীর সস্তা শ্রমকে লুণ্ঠন করা ও বিজ্ঞাপন-নাটক-সিনেমায় অশালীনভাবে নারীকে উপস্থাপন করা অন্যদিকে মৌলবাদী প্রচারণায় নারীশিক্ষার বিরোধীতা করা, নারীকে গৃহবন্দী করার পায়তারা করা দুই-ই নারী নির্যাতনকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। পুঁজিবাদ নারীকে বাজারি পণ্য বানায় আর মৌলবাদ নারীকে তাচ্ছিল্য, অপমান ও গৃহপণ্য করে।
যে নারী পথে চলতে ইভটিজিং এর শিকার হয়, যৌতুকের কারণে নির্যাতিত হয়, যে শিশুর স্নেহ পাওয়ার কথা সে যখন ধর্ষিতা হয় তখন কি আমাদের মনে হয় না সে আমাদেরই কারো প্রিয় সন্তান, বোন, স্ত্রী বা মা? যারা এই জঘন্য ঘটনা ঘটায় তারা কি কারো সন্তান, ভাই, স্বামী বা বাবা নন? নারী যে মাত্রায় নির্যাতিত হয় পুরুষও সেই মাত্রায় অধঃপতিত হয়। তাই নারী নির্যাতন বিরোধী আন্দোলন শুধু নারীদের জন্য নয় সকল মানুষের। অন্যায়ের প্রতিবাদ ছাড়া ন্যায়নীতি মূল্যবোধ জাগে না, মনুষ্যত্ব অর্জন ও রক্ষা করা যায় না। সেজন্য বক্তাগণ সমাবেশ থেকে বাংলাদেশের নারীসমাজসহ সর্বস্তরের মানুষকে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার আহ্বান জানান এবং অবিলম্বে কল্পনা চাকমা, সোহাগী জাহান তনু, মিতু, আফসানাসহ নারী ও শিশু নির্যাতন-ধর্ষণ-হত্যার প্রত্যেকটি ঘটনায় নির্যাতকদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানান।