আসন্ন ভারত সফরের প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রীর নিকট বাসদ এর স্মারকলিপি প্রদান
আসন্ন ভারত সফরের প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রীর নিকট বাসদ এর স্মারকলিপি প্রদান
সংবিধান বর্ণিত জোট নিরপেক্ষ নীতির পরিপন্থি প্রতিরক্ষা চুক্তি নয়, তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করুনপ্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ভারত সফরের প্রাক্কালে তিস্তাসহ ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়, বাণিজ্য ঘাটিত এবং বাংলাদেশের পণ্য ভারতে প্রবেশে অশুল্ক বাঁধা দূর করা, সংবিধান বর্ণিত মর্যাদা সম্পন্ন জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে দেশের স্বার্থ রক্ষা করা এবং অপ্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষা চুক্তি না করার দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বরাবরে বাসদ এর পক্ষ থেকে স্মারকলিপি দেয়া হয়েছে। আজ ৩০ মার্চ ২০১৭ সকাল ১১:৩০টায় বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ উদ্যোগে স্মারকলিপি প্রদানের পূর্বে প্রেসক্লাবের সামনে বাসদ সাধারণ সম্পাদক কমরেড খালেকুজ্জামানের সভাপতিত্বে এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড বজলুর রশীদ ফিরোজ, জাহেদুল হক মিলু, রাজেকুজ্জামান রতন। সমাবেশে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ষ্ট্রাস্টি, বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কমরেড মোহাম্মদ শাহ আলম, গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার সমন্বয়কারী ফিরোজ আহমেদ প্রমুখ।
সভাপতির বক্তব্যে কমরেড খালেকুজ্জামান বলেন, প্রধামন্ত্রীর ভারত সফরের পূর্বে বাংলাদেশের জনগণের মতামত, স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত তো নেয়া হচ্ছেই না এমনকি নিজেদের আজ্ঞাবহ সংসদেও আলোচনা করার প্রয়োজন অনুভব করে নাই।
বাংলাদেশ পানি ও পলির দেশ। ভারত থেকে আসা ৫৪টি নদীর পানি প্রবাহ রুদ্ধ হলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব হুমকীর মুখে পড়বে। বাংলাদেশের তিন দিকেই ভারত। সেই ভারতের ঋণে ভারতের অস্ত্র কিনে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা কিভাবে নিশ্চিত হবে তা বোধগম্য নয়। ভারতের সাথে বাংলাদেশের বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি এর সাথে এন্টি ডাম্পিং বাঁধার কারণে বাণিজ্য বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে। এ সমস্ত বিষয় আলোচনায় না এলে শুধু সৌজন্য সফরে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা হবে না। তিনি সীমান্ত হত্যা বন্ধসহ বাংলাদেশের প্রতি অসম্মানজনক কর্মকা- বন্ধ করতে ভারত সরকারের সাথে আলোচনার দাবি জানান।
সমাবেশ শেষে একটি মিছিল প্রেসক্লাব, পল্টন, হাইকোর্ট, শিশু পার্ক হয়ে শাহবাগে পৌঁছালে পুলিশ বাঁধা দেয়। পরে সেখানে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে বজলুর রশীদ ফিরোজ, জাহেদুল হক মিলু, রাজেকুজ্জামান রতন ও খালেকুজ্জামান লিপনসহ ৪ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গিয়ে স্মারকলিপি প্রদান করে।
স্মারকলিপির কপি সাথে সংযুক্ত করা হলো-
তারিখ: ঢাকা ৩০ মার্চ ২০১৭
শ্রদ্ধেয় প্রধানমন্ত্রী
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়,
এলেন বাড়ী, তেজগাঁও, ঢাকা
বাংলাদেশ।
বিষয়: প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর ও ভারত-বাংলাদেশ সম্বন্ধ-সম্পর্ক, চুক্তি ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষার দাবিতে স্মারকলিপি।
মহাত্মন,
শুভেচ্ছা জানবেন। আগামী ৭ এপ্রিল ভারত সরকারের আমন্ত্রণে আপনি ভারত যাচ্ছেন। সরকারের পক্ষ থেকে এই সফরের উদ্দেশ্য-বিধেয় বা জাতীয় স্বার্থে কোন্ কোন্ বিষয় উত্থাপিত এবং আলোচিত হবে কিংবা কোন সমঝোতা বা চুক্তি হবে কিনা, প্রতিবেশী দেশ হিসাবে বৈষম্যমূলক, স্বার্থহানিকর বৈরীতা নিরসনকল্পে কোন প্রস্তাবনা তুলে ধরা হবে কিনা বা বহুদিনের ঝুলে থাকা অমীমাংসেয় বিষয়-আশয়ের নিষ্পত্তিকল্পে সুনির্দিষ্ট বিষয় ফয়সালার মুসাবিদা হাজির করা হবে কিনা-এর কোনটাই দেশবাসীকে জানানো হয়নি। পার্লামেন্টের গঠন প্রক্রিয়া ও প্রকৃতি যাই হোক সেখানেও কোন আলোচনা হয়নি। বিভিন্ন বিষয়ের, পর্যায়ের ও স্তরের বিশেষজ্ঞদের ডেকে দাবি পূরণের দরকষাকষির সক্ষমতা লাভের কোন প্রচেষ্টাও পরিলক্ষিত হয়নি। রাজনৈতিক দলসমূহের সাথেও বিরোধের জায়গা এড়িয়ে জাতীয় স্বার্থে সহমত প্রদর্শনপূর্বক পারস্পরিক স্বার্থ হাসিলে সরকারের পক্ষে জনমত ভারী করার কোন প্রচেষ্টাও আমরা দেখিনি। অথচ দু’দেশের পত্র-পত্রিকায় অহরহ এ বৈঠকের আকাশ ছোঁয়া প্রত্যাশা, প্রাপ্তির নড়বড়ে দশা ও প্রায় অর্ধশত চুক্তি-সমঝোতা ইত্যাদি তথ্য প্রচার করে চলেছে। শাসক দল এবং ক্ষমতাপ্রত্যাশী দলের বাহাসও চলছে সমানতালে। এ অবস্থায় আমরা সম্মানিত প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলতে চাই –
১. বাংলাদেশ ভারতের সাথে উষ্ণ বন্ধুত্বের দোহাই যত দিচ্ছে ভারতের বঞ্চনাধর্মী বৈরী আচরণ ততই তার অসারতা ফুটিয়ে তুলছে। সীমান্তে কাঁটা তারের বেড়া, প্রতিনিয়ত সীমান্তে হত্যা, ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ঘাটতি, অশুল্ক বাঁধা আরোপে বাংলাদেশী পণ্যের প্রবেশ বন্ধ, ভারত হয়ে আসা ৫৪ আন্তর্জাতিক নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা না দেয়া, ভারত সরকারের উঁচু মহল থেকে সাম্প্রদায়িক উস্কানীমূলক বক্তব্য ও কর্মকা- যার অভিঘাতে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি পরোক্ষ মদদ পায়, বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে মাদক ও অস্ত্র পাচার ইত্যাদি গভীর মনযোগ আকর্ষণ করে।
২. তিস্তায় পানির প্রবাহ শীত মৌসুমে ১০০০০ কিউসেক পানির স্থলে ৪০০/৫০০ কিউসেক এ এসে ঠেকেছে। সাবেক পরিস্থিতির আলোকে সুনির্দিষ্ট চুক্তি ও ৫৪ নদীর পানি বন্টন বিষয়ে দফাওয়ারী মীমাংসার সুস্পষ্ট অঙ্গীকার বাঞ্ছনীয়। নদী সংশ্লিষ্ট নেপাল, ভূটান, ভারত, চীন ও বাংলাদেশ মিলে যৌথ নদী কমিশন গঠন করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর সাথে সুর মিলিয়ে ফারাক্কা বাঁধ তুলে ফেলার দাবিও সময়োপযোগী হবে। গঙ্গাচুক্তির সময় অপরাপর নদীসমূহের পানি বন্টনের কথা উল্লেখ থাকলেও আজ অবধি তা বাস্তবায়ন হয়নি। তিস্তার পানি অপসারণের কারণে বছরে দশ হাজার কোটি টাকার ক্ষয়-ক্ষতি ও ফারাক্কা চুক্তি সত্ত্বেও চুক্তি অনুযারী পানি না পাওয়ায় পানি সংকটে ১৮ জেলার ৪ কোটি মানুষের ক্ষয়-ক্ষতিসহ বছরে প্রায় ১ লক্ষ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণের দাবি উল্লেখ করা সমীচীন হবে। টিপাই বাঁধ ও আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বন্ধের সুস্পষ্ট অঙ্গীকারের কথা তোলা প্রয়োজন।
৩. কোন সামরিক বা প্রতিরক্ষা চুক্তি বাংলাদেশের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়। তা হবে সংবিধানে উল্লেখিত জোট নিরপেক্ষ নীতির সুস্পষ্ট বরখেলাপ। এটা ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতিকে পক্ষাবলম্বনের ঝুকিতে ঠেলে দিতে পারে। অস্ত্র ক্রয়-বিক্রি ও ভারতের সাথে বন্দুক বান্ধব সামরিক সমঝোতাও সহায়ক নয়। কারণ ভারতীয় সমরাস্ত্র আন্তর্জাতিক মানের নয়। তাছাড়া ভারতের সামরিক রণনীতি-রণকৌশল বাংলাদেশের সমার্থক নয়। ভারত-ইসরাইল-মার্কিন জোটবদ্ধ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের সামিল হওয়া আত্মঘাতি হতে পারে। তাছাড়া বন্ধুত্বের দাবিদার শক্তিশালী ভারত স্থলে-জলে চতুর্দিক বেষ্টিত। তাহলে সামরিক চুক্তির দরকার কী? ভারতের জঙ্গি ও সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতিও বাংলাদেশের সাথে মেলেনা।
৪. সীমান্ত হত্যা একটা মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসাবে গণ্য করে প্রতিটি হত্যাকা-ের বিচার করার ব্যবস্থা করতে হবে। চোরাচালানী বলে মানুষ হত্যা জায়েজ হতে পারে না। এটাও বন্ধুত্ব বিনষ্টকারী একটা উপাদান। এ হত্যা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে ভারতের অঙ্গিকার আদায় করতে হবে।
৫. বাংলাদেশ ভারতের সাথে বাণিজ্য ঘাটতিতে রয়েছে। ভারতের বিশাল বিনিয়োগ ও বাজার বিশ্বে ছড়িয়ে রয়েছে। ফলে বাংলাদেশের সাথে বাণিজ্য ঘাটতি দূরীকরণে শুল্কমুক্ত সুবিধা সকল পণ্যের ক্ষেত্রে অবারিত হলে ভারতের তেমন লাভ-ক্ষতি হবেনা। পাটজাত পণ্য এন্টিডাম্পিং শুল্কের প্রস্তাবনা বাতিল করার ঘোষণা দাবি করা প্রয়োজন। একই সাথে ভারতে বাংলাদেশী পণ্যের প্রবেশে অশুল্ক বাঁধা দূর করার দাবিও জোরের সাথে উচ্চারণ করতে হবে।
৬. ভারত সরকারের উঁচু পদের ব্যক্তিবর্গ থেকে বিভিন্ন স্তরের বিশেষ করে উত্তর প্রদেশের নব নিযুক্ত মুখ্যমন্ত্রীর সাম্প্রদায়িক উস্কানীমূলক বক্তব্য ও অপরাপর সাম্প্রদায়িক কর্মকা- বন্ধে আলোচনা হওয়া দরকার। কারণ ভারত একটি ঘোষিত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশের হিন্দুদের ভারতে নাগরিকত্ব দেয়ার ঘোষণা বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দেয়ার সামিল, এ বিষয়েও ভারত সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা জরুরী।
৭. ট্রানজিট-ট্রানশিপমেন্টের ক্ষেত্রে এর পরিপূরক বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ অবকাঠামোগত ব্যয় ও পণ্য পরিবহনে মাশুল বৃদ্ধির কথা আলোচনায় আশা প্রয়োজন।
অতএব আমরা মনে করি দীর্ঘদিন পরে হলেও আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে সমুদ্র সীমা নির্ধারণ ও দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় স্থল সীমান্ত চুক্তি সম্ভব হয়েছে। তারপরও বহু বিষয় অমিমাংসিত থেকে গেছে। পারস্পরিক স্বার্থ ও সমমর্যাদার ভিত্তিতে দ্বিপাক্ষিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সঠিক উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা নিলে ঐ সকল বিষয়ের নিষ্পত্তিও অসম্ভব নয়। তবে প্রধানমন্ত্রীর এবারের ভারত সফরে বাংলাদেশের জনগণের আকাংখার বিপরীতে গিয়ে কোন চুক্তি-সমঝোতা সমীচীন হবে না। তিস্তাসহ ৫৪ নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা ছাড়া অন্য কোন আলোচনা এ সময় প্রাসঙ্গিক হবে না।
আশা করি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিষয়সমূহ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করি।
নিবেদক-
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ
এর পক্ষে
(খালেকুজ্জামান)
সাধারণ সম্পাদক
বাসদ, কেন্দ্রীয় কমিটি।