ঘোষিত নির্বাচনী তফসিল স্থগিত করে পুনঃতফসিল ঘোষণা করুন, রাজনৈতিক সমঝোতার আগে তফসিল ঘোষণা গণআকাঙ্খার পরিপন্থী-প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সমাবেশে কমরেড খালেকুজ্জামান
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ এর ৩৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও রাশিয়ার মহান অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ১০১তম বার্ষিকী উপলক্ষে ০৯ নভেম্বর ২০১৮ শুক্রবার বেলা ৩:৩০টায় ঢাকাস্থ জাতীয় ক্লাবের সমানে সমাবেশ ও লাল পতাকা মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক কমরেড খালেকুজ্জামান। বাসদ ঢাকা মহানগর আহ্বায়ক কমরেড বজলুর রশীদ ফিরোজের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে আরো বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড রাজেকুজ্জামান রতন। সভা পরিচালনা করেন কমরেড নিখিল দাস।
সমাবেশে কমরেড খালেকুজ্জামান বলেন, গত ৭ নভেম্বর ছিল আমাদের দলের ৩৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও রুশ বিপ্লবের ১০১তম বার্ষিকী। সেই উপলক্ষে আজকে আমাদের এই জনসমাবেশ। এই সমাবেশে আমরা এমন সময়ে মিলিত হয়েছি যখন দেশে রাজনীতির ময়দান থেকে অতীতের অশুভ ছায়ার বিস্তার সরেনি। জাতীয় রাজনৈতিক সংলাপের মধ্যদিয়ে জনগণের যে আশাবাদ তৈরি হয়েছিল তা পূরণ হয়নি, পাশাপাশি আশঙ্কার যে কালোমেঘ জমাট বাধাছিল তাও প্রত্যাশিতরূপে সরানো যায়নি। সংলাপ শেষ হলেও আলোচনা শেষ হয়নি, এই ঘোষণা সরকারের পক্ষ থেকে থাকার পরও তড়িঘড়ি ১ দিনের মাথায় নির্বাচন তফসিল ঘোষণার মধ্যদিয়ে নির্বাচন কমিশন তাদের প্রতি অনাস্থার একটি বাড়তি বোঝা স্বেচ্ছায় মাথায় তুলে নিলেন। তফসিল পরিবর্তনের অতীত নমুনা ও বিদ্যমান বাস্তবতায় আমরা এ সভা থেকে তা স্থগিত এবং পিছিয়ে নেবার দাবি জানাচ্ছি। শাসক দল সংলাপে যতটা আন্তরিকতা প্রদর্শন করেছেন তার চেয়েও বেশি ক্ষমতার হারানোর ঝুঁকি ও অশুভ শক্তির অনুপ্রবেশ আশঙ্কার ইঙ্গিত করে সন্তোষজনক সমাধানের পথ এড়িয়ে গেছেন। দলিল জরীপে তালগাছটির মালিকানা নির্ধারণের পরিবর্তে তালগাছটি আমার এই সিদ্ধান্তে কর্তব্য কর্ম পালনে তারা অবিচল রয়েছেন। ফলে একটা সংকট কাটাতে গিয়ে আরেকটা বড় সংকট তৈরির অতীত পুনরাবৃত্তির দিকেই দেশকে ঠেলে দেয়া হলো কিনা সে উৎকণ্ঠা থেকেই গেলো।
খালেকুজ্জামান বলেন, ১৯৭৩ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১০টি সংসদ নির্বাচন হয়েছে। তাতে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিক ক্ষমতা হস্তান্তরের পথ সুগম হয়নি, পার্লামেন্টারী ব্যবস্থা কার্যকারীতা লাভ করেনি, সুশাসন কিংবা গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা পায়নি, জনগণের ক্ষমতায়ণ হয়নি, দিনে দিনে পার্লামেন্ট ব্যবসায়ীদের ক্লাব এর রূপ নিয়েছে। রাজনীতিকে অঢেল অর্থ-বিত্ত উপার্জনের হাতিয়ার বানানো হয়েছে, দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় দুর্বৃত্ত এবং কায়েমী স্বার্থবাদীদের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা চলে গেছে। ২৪ মে যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত পুলিশের সংশ্লিষ্ট ইউনিটে পাঠানো তথ্য মোতাবেক মাদক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ৪৫০ জনপ্রতিনিধি, ১০ এমপি, ১৫ সাবেক এমপি, অর্ধশতাধিক পৌর মেয়র, দুই শতাধিক কাউন্সিলার, দেড় শতাধিক ইউপি চেয়ারম্যান রয়েছে। এদের আইনের আওতায় আনার খবর নেই কিন্তু মাদক সেবীরা ক্রসফায়ারে যাচ্ছে। ক্ষমতার মালিক জনগণ বলা হলেও ক্ষমতাবৃত্তের বাইরে তারা ছিটকে পড়েছে এবং ক্ষমতাবান প্রভাবশালীদের কাছে জিম্মি হয়ে আছে। গণতন্ত্রের নাম জপতে জপতে কখনো উর্দি পোষাকে, কখনো সিভিল পোষাকে সামরিক কিংবা অসামরিক স্বৈরশাসনই জনগণের কাঁধে চাপানো হয়েছে। এ জাতি কখনও গণশাসনের অর্থে গণতান্ত্রিক শাসনের মুখ দেখেনি। সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর সামাজিক সুবিচার এর ঘোষণা দিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল আর স্বাধীন দেশে মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ সংবিধানে লিপিবদ্ধ হয়েছিল। এর সব কিছু আজ ধূসর মলিন। বহুস্থানে বিকৃত ও বিধ্বস্ত। সাম্য এখন চরম বৈষম্যে পরিণত এবং আরও বেশি বৈষম্যের লক্ষ্যে ধাবিত। সাধারণ মানুষের মানবিক মর্যাদা পদে পদে লাঞ্ছিত, সামাজিক সুবিচারকে অনাচার-অবিচার বিচারহীনতা গ্রাস করে ফেলেছে অনেক আগেই। সর্বত্রই বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। কোন কোন বিচার ২০ বছরও ঝুলে থাকে, আবার কোনটা ২০ দিনও সময় নেয়না। বিচার বহির্ভূত তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধের হত্যাকা- তো চলছে অবিারম। এ বছরের ৯ মাসে ৪১৩ জন হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে। তার সাথে যুক্ত হয়েছে যা ঘটেনি, যে বা যারা থাকেনি তাদের নামে বেনামে গায়েবী মামলার নির্যাতন, হয়রানী আতঙ্ক ও গ্রেপ্তার বাণিজ্য। বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা খণ্ডিত। এক্ষেত্রে নির্বাহী কর্তৃত্ব প্রবল প্রতাপে প্রতিভাত। তাছাড়া সুবিচার বা ন্যায্য বিচারের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাসমূহ যেমন ত্রুটিপূর্ণ এজহার, বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তা একই ব্যক্তি হওয়া, জব্দ তালিকা বর্ণনা সাক্ষীদের সাথে অমিল হওয়া, সাক্ষী হাজির করার ব্যর্থতা, বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষী আনতে না পারা, বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষী না পাওয়া, আইন অনুযায়ী জব্দ তালিকা না করা, বাদী অভিযানকারী দলের সদস্যদের বক্তব্যে অমিল, ওয়ারেন্ট ছাড়া গ্রেপ্তার, নির্দিষ্ট সময়ে আদালতে হাজির না করা, ইউনিফর্ম ছাড়া তল্লাশী, গ্রেপ্তার তৎপরতা, গ্রেপ্তার করে অস্বীকার করে গুম করে ফেলা, থানা হাজতে কিংবা রিমান্ডে শারিরীক-মানসিক নির্যাতন, সঠিক ময়না তদন্ত না হওয়া, ভয়-ভীতি প্রদর্শন পূর্বক টাকা আদায়, অপরাধের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার না হয়ে গ্রেপ্তারের পর অপরাধের আইনী খড়গে ফেলা ইত্যাদি প্রতিকারের বদলে গা-সহা ও স্বাভাবিক করে ফেলা হয়েছে।
তিনি বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় ভারসাম্যমূলক যে প্রথা প্রতিষ্ঠানসমূহ থাকা দরকার যেমন বিচার ব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, আমলা প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ইত্যাদির গণতন্ত্রায়ণ জরুরি। পাশাপাশি রাজনৈতিক পরিবেশ, রাজনৈতিক দলসমূহের আচরণ ও সংস্কৃতি, আইন কানুন বিধি বিধান ইত্যাদির গণতন্ত্রায়ণও সমভাবে প্রযোজ্য। কিন্তু স্বাধীনতাত্তোর ভ্রষ্ট পথে নষ্ট রাজনীতি দ্বারা দেশ পরিচালিত ও শাসিত হওয়ার কারণে স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও একটা সুষ্ঠ নির্বাচন করার ক্ষমতা শাসক বুর্জোয়াশ্রেণি হারিয়ে ফেলেছে। অর্থ ব্যবস্থাকে লুটপাটের স্বেচ্ছাচারে নিয়ে গেছে। সাদা অর্থনীতিকে কালো অর্থনীতি ঢেকে ফেলেছে। ব্যাঙ্ক লুট, পুঁজিবাজারের অর্থ লুট, বিদেশে লক্ষ হাজার কোটি টাকা পাচার চলছে লাগামহীনভাবে। ৫০০ কোটি টাকা ঋণের দায়ে ১৬৮০০০ কৃষকের নামে মামলা, ১১৭৭২ জনের নামে ওয়ারেন্ট। অথচ হলমার্ক, ডেসটিনি আর যুবকের ১২০০০ কোটি টাকা উদ্ধার হয়নি। ৫ বছরে ১টি গ্রুপ জনতা ব্যাঙ্ক থেকে ৫১৩০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে যার পুরোটাই প্রায় খেলাপী। এর আগেও ১ গ্রাহক ৫৫০৪ কোটি টাকা নিয়ম ভঙ্গ করে ঋণ সুবিধা নিয়েছিল। (প্রতিদিন ১৮ জুলাই ২০১৮) বৈষয়িক উন্নয়নের ঢাক যতো পেটানো হচ্ছে, মানবিক, নৈতিক, আদর্শিক মূল্যবোধ ততো নিম্নগামী হয়ে পড়েছে। ধনী দরিদ্রের বৈষম্য ভয়াবহ রূপে বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা জরীপ ২০১০-২০১৬ অনুযায়ী সর্বোচ্চ ধনী ৫% পরিবারের আয় বৃদ্ধি যেখানে ৫৭% সেখানে সবচেয়ে দরিদ্র ৫% পরিবারের আয় কমেছে ৫৯%। বেকারত্ব ও কর্মহীনের সংখ্যা বাড়ছে। খাদ্য অধিদপ্তরের (২৪ ক্যাটেগরি) ১১১৬ শূণ্য পদের জন্য আবেদন করেছে ১৩,৭৮,৯২৩ জন। উন্নয়ন বরাদ্দের কোন কোন ক্ষেত্রে ৬০ ভাগের মতো টাকা দুর্নীতিতে যায় বলে ধারনা করা হচ্ছে। যে ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) নির্বাচনে ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রায় সকল দলেরই মতামত ছিল সেই ইভিএম মেশিন প্রতিটার দাম ভারতে ২১,২৫০ টাকা অথচ বাংলাদেশে প্রতিটি ২,৩৪,৩৭৩ টাকায় কেনার উদ্যোগ নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। হরিলুট আর কাকে বলে? প্রতি ৬ মিটিটে একনেক ১টি করে প্রকল্প করে দিচ্ছে। ভোট এবং শাসন ক্ষমতার সাথে সংশ্লিষ্ট সকল মহলকে নানা ধরনের আর্থিক সুবিধাদি দেয়া হচ্ছে। মেধা, যোগ্যতা ও দক্ষতা বিচারে না হওয়ায় এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত পদ ও পদবী প্রসারিত করায় এগুলোকে নির্বাচনী ঘুষ বা নির্বাচনী প্রনোদনা হিসাবে দেখার সুযোগ রয়েছে। দেশের প্রকৃত উন্নয়নের মূল দাবিদার শ্রমজীবী জনগণের ন্যায্য দাবি ও অধিকারেরও কোন স্বীকৃতি নেই। তাদের জীবন মানের উন্নতি তো দূরের কথা মানবিক মর্যাদায় বেঁচে থাকাই দুষ্কর হয়ে পড়েছে। ধর্ষণ, গণধর্ষণ, উত্তক্তকরণ জনিত আত্মহত্যাসহ নারী নির্যাতন এতটাই ভয়াবহ যে ঘরে বাইরে কোথায়ও শঙ্কামুক্ত থাকা যাচ্ছে না। ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক শক্তির সাথে সমঝোতা ও ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার উৎসাহিত করা হচ্ছে সরকার ও বিরোধী উভয় বুর্জোয়া দলের পক্ষ থেকে। শিক্ষা ব্যবস্থা, রাষ্ট্র ও সমাজের ধর্ম নিরপেক্ষ চরিত্র বৈশিষ্টকে বিনষ্ট করা হয়েছে। বহু ধারার শিক্ষা ব্যবস্থাকে খণ্ডিত করে শিক্ষার গুণমান নষ্ট করা হয়েছে এবং সমাজ মনস্তত্বে ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও প্রগতিবিরোধী উপাদান সন্নিবেশিত করা হয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষায় ৪০০ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সবাই পাশ করেছে আবার ৫৫ প্রতিষ্ঠানের সবাই ফেল করেছে। (যুগান্তর ১৮ আগস্ট ২০১৮) অসমতার আরও বহু চিত্র রয়েছে। সবকিছু মিলে যে অবস্থায় দেশ জাতি জনগণ পতিত হয়েছে তার উৎস কোথায়? সেটা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের গণআকাঙ্খা, চেতনা ও অঙ্গীকার এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে পুঁজিবাদী শোষণমূলক পথে দেশ শাসন করার পরিণতির ফলে হয়েছে। প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এ অবস্থার আমূল পরিবর্তনের লক্ষ্যে গণআন্দোলন এবং জনগণের ভোটাধিকারসহ গণতান্ত্রিক মৌলিক অধিকার রক্ষা ও আদায়ের অংশ হিসাবে নির্বাচনকে দেখার জন্য আমরা দেশবাসীর প্রতি এই ক্রান্তিলগ্নে আহ্বান জানাচ্ছি। অবাধ-নিরপেক্ষ সুষ্ঠ অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য আমরা আন্দোলন করছি। সেই পরিবেশ সৃষ্টি হলে আন্দোলনের অংশ হিসেবে আমরা নির্বাচনে অংশ নেব, না হলে বর্জনও করতে পারি। এ লক্ষ্যে সকল বাম প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক শক্তিকে গণতন্ত্র, ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা ও ভাত কাপড় শিক্ষা চিকিৎসা কাজের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন অব্যাহত রাখার আহ্বান জানাচ্ছি।