ছাত্র ফ্রন্টের দশম কেন্দ্রীয় কর্মী সদস্য সম্মেলনের কাজ শুরু
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে কেবল পরীক্ষা গ্রহণের কেন্দ্র নয় প্রকৃত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত কর
আফগানিস্তানে তালেবানগোষ্ঠি নারীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখার ঘোষণার তীব্র নিন্দা
২৬-২৮ ডিসেম্বর’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দশম কেন্দ্রীয় কর্মী সদস্য সম্মেলনের কাজ কমরেড বজলুর রশীদ ফিরোজের বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে অনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা সংকট নিরসনের দাবিতে এবং আফগানিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়ে ও দেশি বিদেশি সকল এনজিওতে নারীদের নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে ছাত্র সমাবেশ, মিছিল ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বরাবর স্মারকলিপি কর্মসূচি করেছে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে সকাল ১১:৩০ টায় সমাবেশে শুরু হয়। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মুক্তা বাড়ৈ। কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক অনিক কুমার দাস এর সঞ্চালনায় সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক রাজিব কান্তি, অর্থ সম্পাদক সুলতানা অক্তার,ছাত্র ফ্রন্ট চট্টগ্রাম কলেজ শাখার সংগঠক মিরাজ উদ্দিন, বরিশাল বি এম কলেজের সাধারণ সম্পাদক বিজন শিকদার, মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ শাখার সংগঠক বিশ্বজিৎ নন্দী, সরকারি আজিজুল হক কলেজের সংগঠক ধনঞ্জয় বর্মন প্রমুখ।
সমাবেশে বক্তারা বলেন, ১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নামক প্রতিষ্ঠানটি পরিকল্পনাহীনভাবে যাত্রা শুরুর পর থেকেই সংকট যেন এর পিছু ছাড়ছে না। সংকট নিরসনে সারা বছর ক্লাস, পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ ও ক্লাসরুম নির্মাণ, স্বতন্ত্র পরীক্ষার হল নির্মাণ এবং ৩ মাসের মধ্যে পরীক্ষার ফল প্রকাশসহ সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের উত্থাপিত ৮ দফা দাবি দেশের সকল শিক্ষক- শিক্ষার্থীসহ শিক্ষানুরাগী মানুষের কাছে সমাধানের পথ হিসেবে হাজির হয়। জাতীয় বিশ্ববিদালয়ের অধিভূক্ত কলেজসমূহে ২টি সফল ছাত্র ধর্মঘট, ঘেরাও, সমাবেশ, দফায় দফায় স্মারকলিপি পেশ, কলেজসমূহের দুরাবস্থার চিত্র তুলে ধরে পুস্তিকা প্রকাশ, পাঁচ সহস্রাধিক শিক্ষার্থী এবং দেশবরেণ্য শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের উপস্থিতিতে ঢাকার পল্টন ময়দানে কনভেনশনসহ ছাত্র আন্দোলনের চাপে ২০০১ সালে তৎকালীন সরকার প্রত্যেক কলেজে স্বতন্ত্র পরীক্ষা হল নির্মাণ করার ঘোষণা দিলেও এখনও পর্যন্ত সকল কলেজে স্বতন্ত্র পরীক্ষা হল নির্মাণ ও তার যথাযথ কার্যক্রম শুরু হয় নি। কিছু কলেজে স্বতন্ত্র পরীক্ষা হল নামে আলাদা ভবন নির্মাণ হলেও সেখানে একাডেমিক বা প্রশাসনিক কার্যক্রমই পরিচালনা করতে দেখা যায়। কলেজগুলোতে ২১০ দিন ক্লাস নেয়ার কথা বলা থাকলেও কোন কলেজেই বাস্তবে ৭০-৮০ দিনের বেশি ক্লাস হয় না। ফলে সিলেবাস শেষ না করেই পরীক্ষা গ্রহন করা হয় কলেজ গুলিতে। এতে শিক্ষার্থীরা নানামুখী সংকটে পড়ছে। ফলে কোচিং-প্রাইভেটের মুখাপেক্ষী হয়ে সিলেবাস সম্পন্ন করতে বাধ্য হচ্ছে। বাস্তবে কলেজগুলো পাঠদানের বদলে পরীক্ষা গ্রহণের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার পূর্বেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কার্যক্রম শুরু করে দেয়। এতে উচ্চশিক্ষার অনিশ্চয়তা থেকে অনেক শিক্ষার্থী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজে ভর্তি হয়, পরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেলেই ভর্তি বাতিল করে চলে যাচ্ছে। এর ফলে অনেক কলেজেই আসন শুন্য থাকছে। আবার শিক্ষার্থীদেরকেও একবার ভর্তি হওয়া আবার ভর্তি বাতিল করতে হাজারখানেক টাকা বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে। এর ফলে প্রতি বছরই হাজার হাজার শিক্ষার্থী চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ হয়রানীর বিষয় কর্তৃপক্ষের কাছে বিবেচ্য নয়, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নেওয়ার দিকেই তাদের বেশি মনোযোগ।
তথাকথিত দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার কথা বলে সম্প্রতি ১২টি পোস্টগ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা (পিজিডি) কোর্স খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। ব্যায়বহুল এই সব বাণিজ্যিক কোর্স শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণকেই প্রসারিত করবে। এর পাশাপাশি চলছে বছর বছর কি বৃদ্ধি। পর্যাপ্ত আবাসন- পরিবহন ব্যবস্থা ছাড়াই চলছে অধিকাংশ কলেজ। কলেজগুলোতে আছে তীব্র শিক্ষক সংকট। নেই লাইব্রেরি- সেমিনারে নতুন সিলেবাস এর পর্যাপ্ত বই। এমনি ভঙ্গুর দশায় চলছে দেশের সবচেয়ে বড় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। সর্বোপরি ক্যাম্পাসে নেই শিক্ষার গণতান্ত্রিক পরিবেশ, বহু বছর ধরে হচ্ছে না ছাত্র সংসদ নির্বাচন। এ বিষয়গুলিকে আমলে না নিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কিভাবে একটি যথার্থ বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারো?
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সারাদেশে কলেজ পর্যায়ে অনার্স, ডিগ্রি এবং মাস্টার্স প্রোগ্রাম সুচারুরূপে পরিচালনা করা এবং উপযুক্ত ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি, সারাদেশের কলেজগুলোর শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং সার্বিক কার্যক্রমে গতিশীলতা আনয়নের কথা বলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এটি অগণতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারী, নিয়ম-বিধি লংঘনকারী একটি আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তাই তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। যে কারণে আমরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালেই বলেছিলাম এটি কোন বিশ্ববিদ্যালয় হবে না, হবে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষা বোর্ড মাত্র।
সম্প্রতি অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তির যোগ্যতায় গ্রেড পয়েন্ট বাড়িয়ে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষায় প্রবেশের পথকেই রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। প্রশাসনিক দিক থেকে অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম-দুর্নীতি ও দলীয়করণের ফলে সৃষ্ট সমস্যা অপরাপর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতোই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েও অত্যন্ত প্রকট। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে স্বায়ত্তশাসনের ধারণা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাধাহীন ও সরকার প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণমুক্ত গণতান্ত্রিক ও স্বাধীন পরিবেশ ছাড়া উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে একাডেমিক স্বাধীনতা যেমন জরুরি, তেমনি প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসনও সমান গুরুত্বপূর্ণ। উচ্চশিক্ষার সংকট নিরসন ও দেশের উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণ সকল শিক্ষার্থীর জন্য উচ্চশিক্ষার সুযোগ অবারিত করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি করেছি জেলায় জেলায় স্বায়ত্তশাসিত পূর্ণাঙ্গ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ করে জেলার অন্যান্য কলেজকে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করে পরিচালনা করার জন্য। সরকার সেদিকে না গিয়ে সকল সরকারি কলেজকে দেশের কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এনে পরিচালনার তুঘলকি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পর্যাপ্ত অবকাঠামো নির্মাণ ও দক্ষ জনবল নিয়োগ না করে সরকারের এহেন সিদ্ধান্তের ফলে এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় সরকারের এই অবান্তর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অপারগতা প্রকাশ করছে। সরকার শিক্ষার্থীদেরকে গিনিপিগ বানিয়ে যুগের পর যুগ লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীদের জীবন ধ্বংস করছে । সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট ধারাবাহিকভাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা সংকট নিরসনের দাবিতে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা তুলে ধরে আন্দোলন করছে। আগামীদিনেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরাজমান সংকট চিহ্নিত করে সমাধানের দাবিতে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গিকার করছে। আগামীদিনের আন্দোলন সংগ্রামে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থী-শিক্ষক-অভিভাবকদের নৈতিক সমর্থন, অংশগ্রহণ আমরা প্রত্যাশা করি। একই সাথে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি প্রকৃত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার সংগ্রামকে বেগবান করার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাই।
নেতৃবৃন্দ আরও বলেন,গত বছর তালেবান ক্ষমতায় আসার পর থেকে নারী শিক্ষাকে ক্রমাগত সংকুচিত করার পদক্ষেপ নিয়েছে। সাম্প্রতিক এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে উচ্চ শিক্ষায় নারীর প্রবেশাধিকার আরও খর্ব করা হল। দেশটিতে ইতিমধ্যে বেশিরভাগ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে নারী শিক্ষার্থীরা বাদ পড়েছে।
‘ধর্মভিত্তিক মৌলবাদী চিন্তার প্রসারে সে দেশের নারীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নারীর শিক্ষা, স্বাধীনভাবে চলাফেরা, মতামত প্রকাশ বাধাগ্রস্ত হয়, ভূলুণ্ঠিত হয় নারীর অধিকার ও মর্যাদা।আফগানিস্তানে তালেবানগোষ্ঠি নারীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখার ঘোষণার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান এবং অনতিবিলম্বে তালেবান সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাতিল করার আহ্বান জানায় নেতৃবৃন্দ।
সমাবেশ শেষে একটি মিছিল ক্যাম্পাসের কলা ভবন প্রদক্ষিণ করে রাজু ভাষ্কর্যে এসে শেষ হয়। চারজন প্রতিনিধি গাজীপুর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনিক দপ্তরে গিয়ে ভিসি বরাবরে স্মারকলিপি পেশ করেন।
২৬-২৮ ডিসেম্বর ‘ সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের দশম কেন্দ্রীয় কর্মী সদস্য সম্মেলন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক কমরেড বজলুর রশীদ ফিরোজের বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে দশম কর্মী সদস্য সম্মেলনের অনুষ্ঠানিক উদ্ভোদন করেন। সম্মেলনে আরও উপস্থিত আছেন বাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য কমরেড নিখিল দাস,কমরেড জর্নাধন দত্ত নান্টু। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মুক্তা বাড়ৈ,পরিচালনা করেন সাধারণ সম্পাদক শোভন রহমান।