হকার উচ্ছেদ : গরিব মানুষের ওপর নিষ্ঠুর আক্রমণ
গত ১২ নভেম্বর ’১৬ গুলিস্তান-মতিঝিল- পল্টন-প্রেসক্লাব এলাকার ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদের তৎপরতা শুরু করে ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। সেই উচ্ছেদ অভিযান এখনও অব্যাহত আছে। অভিযানে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের পাশাপাশি নেমেছে মেজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমান আদালত ও শত শত পুলিশ। বুলডোজার দিয়ে নিমিষে গুড়িয়ে দেয়া হলো হকারদের ফুটপাতের দোকানপাট, চৌকি, বক্সসহ মালামাল। উচ্ছেদের সমর্থনে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতারা পিস্তল, রিভলবার থেকে গুলিও ছোড়ে, হকিস্টিক, বাঁশ ও লাঠি নিয়ে হকারদের ধাওয়া করে। এতে অনেক হকার আহত হয়। তারা মালামাল সরানোর জন্য সময় চায় কিন্তু কোন সময় তাদের দেওয়া হয়নি। হকাররা কিছুটা প্রতিরোধের চেষ্টা করে এই অজুহাতে তাদের বিরুদ্ধে হয়রানীমূলক মামলা করা হয়েছে। এই দৃশ্য পথচারি, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে দেশবাসী দেখেছে।
মেয়রের বক্তব্য, ‘বঙ্গভবনে ভিভিআইপিদের যাতায়াতের দুই পাশে হকারদের বসতে দেওয়া যাবে না, ফুটপাত ও রাস্তা হকার মুক্ত করা হবে, শহরকে যানজট মুক্ত রাখতে হবে; নগরবাসী বা পথচারীদের চলাচলের রাস্তা কেউ দখলে রাখতে পারবে না’।
প্রশ্ন হচ্ছে এই উচ্ছেদকৃত হকারদের জীবন-জীবিকার উপায় কী হবে? তারা কোথায়-কখন-কীভাবে বসে তাদের ব্যবসাপাতি চালাবে? ফুটপাতে বসতে না পারলে তাদের বিকল্প কর্মসংস্থান কী হবে, কে তার দায়িত্ব নিবে? এই সব প্রশ্নের উত্তর কেউ দেয়নিÑনা রাষ্ট্র, না মেয়র। হকার উচ্ছেদ ও পুনর্বাসনের নীতিমালা ছাড়া এই উচ্ছেদ হবে গরিব হকারদের রুটি-রুজির ওপর আক্রমণ বা পেটে লাথি মারার শামিল। তাই হকারদের পক্ষ থেকে যৌক্তিক দাবিÑতাদের পুনর্বাসন করতে হবে; পুনর্বাসন ছাড়া উচ্ছেদ করা যাবেনা; উচ্ছেদ অভিযান অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। এই সব ন্যায্য দাবিতে সাধারণ হকার, হকার সংঠনগুলো শান্তিপূর্ণ মিছিল-মিটিংসহ নানা কর্মসূচি পালন করছে, বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের নিকট ধরনা দিচ্ছে। প্রতিদিন তারা কর্মসূচি পালন করছে। এখন পর্যন্ত এই সমস্যার কোন সুরাহা হয়নি।
উচ্ছেদ অভিযান সম্পর্কে গত ১১ জানুয়ারি ’১৭ নগর ভবনে এক বৈঠকে মেয়র ঘোষণা দেন, ‘রোববার থেকে সাপ্তাহিক কোন কর্ম দিবসে আর গুলিস্তান ও আশপাশের এলাকায় দিনের বেলায় হকার বসতে দেওয়া হবে না। তারা দোকান নিয়ে বসতে পারবে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার পরে, তবে ছুটির দিনে এই নিয়ম প্রযোজ্য হবে না’।
বাস্তবতা হলো সন্ধ্যা ৬টার পর মাত্র কয়েক ঘণ্টা সময়ে যে পরিমাণ মালামাল বিক্রি হবে তা দিয়ে কি একটা পরিবার চলতে পারবে? হকাররা বলেন, ‘সন্ধ্যার পর মতিঝিলে অফিস পাড়ায় মানুষ জন থাকে না, আমরা তখন কার কাছে বিক্রি করবো’। উচ্ছেদ অভিযানে দীর্ঘদিন ধরে হকারি করে জীবিকা নির্বাহ করা মানুষগুলো আক্ষরিক অর্থে দিশেহারা হয়ে পড়েছে।
লক্ষ লক্ষ বেকারের দেশে সরকার কর্মসংস্থানে ব্যর্থ। মানুষ আবার স্ব-উদ্যোগে ফুটপাতে সস্তা জিনিসপাতি বিক্রি করে কোন রকমে দিন গুজরান করবে সেই সুযোগও নেই। বিগত সময়ে হকারদের পুনর্বাসনের জন্য হকার মার্কেট নির্মাণ করা হয়েছিল কিন্তু প্রকৃত হকাররা কোন দোকান বরাদ্দ পায়নি বা দোকান নেওয়ার মতো পুঁজিও তাদের নেই। দোকান পেয়েছে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা। সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে বিভিন্ন জায়গায় যে সব দোকান ও মার্কেট নির্মাণ করা হয়েছিল সেখানেও হকাররা দোকান পায়নি। অভিযোগ আছে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ফুটপাত দখল করে হকার বসিয়ে ও চাঁদাবাজি করে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
এর আগে রাস্তার যানজট মুক্ত করার নামে শহরের বিভিন্ন সড়কে রিক্সা চলাচল বন্ধ করেছিল। কিন্তু তাতে তো কোন রাস্তা যানজট মুক্ত হয়-ই নি বরং বেড়েছে। একই ভাবে বস্তি উচ্ছেদ করেছে কিন্তু দখলদার মুক্ত হয়নি। ১০ বছরেও হাজারিবাগের ট্যানারি সরাতে পারেনি। ট্যানারি মালিকদেরকে সাভারে প্লট দেয়া হয়েছে। শহরের ৪ দিকে ৪ টি নদী, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু। কারখানা বর্জ্য ও পয়োবর্জ্যে এ ৪ নদী বড় নর্দমায় পরিণত হয়েছে। ঢাকার অভ্যন্তরে জলাশয়, খেলার মাঠগুলো দখলে, দখলদার মুক্ত করা যায়নি। হাতিরঝিলে বেগুনবাড়ী বিজিএমইএ ভবন ক্ষমতা ও দখলদারিত্বের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। বাংলাদেশের দুই প্রধানমন্ত্রী যারা একজন ক্ষমতায় অন্যজন বাইরে, যারা পরস্পর মুখদর্শন করতে চান না কিন্তু এই বিশাল ভবনের ভিত্তি প্রস্তর উভয়ে উদ্বোধন করেছেন। দখলদারদের প্রতি ক্ষমতাসীনদের স্নেহ ও সহযোগিতার এ এক অনুপম (!) দৃষ্টান্ত। ঢাকা শহরে ৪৩ টি খাল, যার ১৮ টির এখন অস্তিত্ব নাই। বাকিগুলো দখলদারদের চাপে সংকুচিত হতে হতে ড্রেনের আকৃতি নিয়েছে। এর জন্য সরকার কার্যকর কিছু কী করেছে?
পত্রিকায় ছবিসহ খবর বেরিয়েছেÑরাস্তা ও ফুটপাত হকার মুক্ত হলেও মতিঝিল, দিলকুশা, স্টেডিয়ামের চারপাশ, ক্লাবপাড়াসহ গোটা অফিস পাড়ার রাস্তার দুধারে সকাল ১০টার দেখা যায় সারি সারি গাড়ি পার্কিং করে রেখেছে ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবীরা। দিনের বেলায় নটরডেম কলেজ সড়কে বিভিন্ন জেলার বিলাসবহুল বাসও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। সেই গাড়ির ওপর বুলডোজার গিয়ে পড়েনা, পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেটকে তখন খুঁজে পাওয়া যায় না।
মতিঝিল-গুলিস্তানের হকাররা জানান, ভ্রাম্যমান আদালতের ভয়ে সারাক্ষণ চোর-পুলিশ খেলায় মত্ত থাকলেও বিভিন্ন সংগঠন, পুলিশের নামে তোলা চাঁদার হার কমেনি, লাইনম্যানকে আগের মতো টাকা দিতে হয়। হকার বসানো নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের বাণিজ্য চলছেই।
ঢাকা শহরকে সুন্দর করতে হবেÑআক্রমণের শিকার লক্ষ লক্ষ হকার-রিক্সা চালক-বস্তিবাসী, ন্যায্য বেতনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে শ্রমিক, ফসলের ন্যায্য মূল্য পাবেনা কৃষক, শিক্ষা-চিকিৎসা, বাসস্থান পাওয়ার সুযোগ নেই মেহনতী মানুষের। এদের অধিকার দেখার দায় নেই রাষ্ট্রের। এরাই অর্থনীতির চাকা সচল রাখে, ভোটের বাক্সা ভর্তি করে কিন্তু রাষ্ট্র এদের কর্মসংস্থানের দায়িত্ব নেয় না বরং নিজেরা জীবন-জীবিকার যে ব্যবস্থা করেছিল সেখান থেকে উচ্ছেদ করে। শাসকের বুলডোজারের নিচে চাপা পড়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন এবং সম্বল। পুনর্বাসন ছাড়া হকার উচ্ছেদ শুধু অমানবিক নয় অগণতান্ত্রিক এবং অন্যায়। এ অন্যায়ের প্রতিবাদ করা গণতন্ত্রকামী মানুষের অবশ্য বর্তব্য। হকারদের পুনর্বাসন এবং বিকল্প কর্মসংস্থানের দাবিতে তাই সবার এগিয়ে আসা প্রয়োজন।