বাসদ এর সমর্থক শুভানুধ্যায়ীদের ২১তম বার্ষিক মিলন মেলা অনুষ্ঠিত
সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীদের ২১ তম বার্ষিক মিলনমেলা
সংগ্রামের চার দশক উপলক্ষে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের ছাত্র সমাবেশ অনুষ্ঠিত-ছাত্র রাজনীতি বন্ধের চক্রান্ত রুখে দাঁড়ান

আজ ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ বিকেল ৩টায় গণতন্ত্র, নির্বাচন, সংবিধান, সুশাসন ইত্যাদি বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত সংস্কার কমিশনের সুপাশি নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে ফ্যাসিবাদ বিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের এক মতবিনিময় সভা ২২ বেইলী রোডস্থ ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অনুষ্ঠিত হয়। মতবিনিময় সভায় বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের পক্ষ থেকে সাধারণ সম্পাদক কমরেড বজলুর রশীদ ফিরোজ, উপদেষ্টা কমরেড খালেকুজ্জামান, সহকারী সাধারণ সম্পাদক কমরেড রাজেকুজ্জামান রতন অংশগ্রহণ করেন। মতবিনিময় সভার সভাপতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের সূচনা বক্তব্যের পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন। বাসদের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন সাধারণ সম্পাদক কমরেড বজলুর রশীদ ফিরোজ। পেশকৃত লিখিত বক্তব্য নিন্মরূপ:-
মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা,
উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্যবৃন্দ, ঐকমত্য কমিশনের সদস্যবৃন্দ, ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের শ্রদ্ধেয় নেতৃবৃন্দ, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদের পক্ষ থেকে সকলকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা।
সংবিধান, নির্বাচন, সুশাসন, গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে সংস্কার কমিশনসমূহের প্রস্তাব নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে রাজনৈতিক দলসমূহের আলোচনা অনুষ্ঠানে আমাদের দলকে আমন্ত্রণের জন্য ধন্যবাদ জানাই। বিগত ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে নানা স্তরে এবং নানা পর্যায়ের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় সংঘটিত হয়েছে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান। তীব্র রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদী সরকারকে উচ্ছেদ করার মাধ্যমে মানুষ শুধু বিজয়ী হয়েছে তাই নয়, তাদের দাবির ন্যায্যতাও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
ফলে শুধু রাজনৈতিক দলসমূহ নয় সমাজের সকল স্তরের মানুষের বিপুল প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে অভ্যুত্থান পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কাছে। গণমানুষের প্রত্যাশার চাপ বিপুল। সরকারের সামনে চ্যালেন্জও অনেক। দেশে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে মানুষের ভোটাধিকার ও নিয়মতান্ত্রিক ক্ষমতা হস্তান্তরের পথ সুগম হবে এই আকাঙ্খা মানুষের দীর্ঘদিনের। এই আকাঙ্খা পূরণ করতে হলে সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন যেমন দরকার তেমনি দরকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপযোগী আইন, শাসন-প্রশাসন, পুলিশ ব্যবস্থা। আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা মনে করি জনমতের সঠিক প্রতিফলন, জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা রাখার মত নির্বাচন ব্যবস্থা তৈরি করতে হলে প্রয়োজন নির্বাচনের উপর সরকারের হস্তক্ষেপ, নিয়ন্ত্রণ বন্ধ করা, টাকা, পেশি শক্তির প্রভাব মুক্ত করা এবং সাম্প্রদায়িকতাকে নির্বাচনে ব্যবহার বন্ধ করা। আমরা মনে করি এই কঠিন অথচ প্রয়োজনীয় কাজ করতে সরকারের সামর্থ্য, সময় এবং পদক্ষেপ নিয়ে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনার প্রয়োজন আছে। পাশাপাশি আমরা একটি বিষয় বলে রাখতে চাই।
বাংলাদেশের মানুষ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়ছে বারবার। জনগণের আন্দোলনের মুখে স্বৈরাচার বিদায় হলেও প্রতিবারই ক্ষমতাসীনদের মধ্যে দুর্নীতিবাজ ও স্বৈরাচারী হবার প্রবণতা গড়ে উঠেছে। শুধুমাত্র আইন বদলালেই স্বেচ্ছাচারী হওয়া প্রতিরোধ করা যায় না, জনগণের সচেতনতা এবং প্রতিবাদ-প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলাটাও দরকার। ফলে স্বৈরাচার বিরোধী গণতান্ত্রিক লড়াই অব্যাহত রাখা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে অন্যতম রক্ষাকবচ। মত প্রকাশের স্বাধীনতা, আন্দোলনের স্বাধীনতা ছাড়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অগ্রসর করে নেয়া সম্ভব নয়।
সংস্কার কমিশনসমূহ যে সমস্ত সুপারিশ দিয়েছে তা গণতান্ত্রিক অধিকার বিকশিত করার পক্ষে কতটুকু সহায়ক সেটা নিয়ে বিস্তারিত ও গভীর পর্যালোচনার প্রয়োজন রয়েছে। বিগত কয়েক মাসে জনগণ জীবন, রক্ত ও অশ্রুর বিনিময়ে স্বৈরাচারকে পরাজিত করে যে অন্তত নিয়মতান্ত্রিক নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা তৈরি করেছে —মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধান, স্থানীয় নির্বাচন আগে না জাতীয় নির্বাচন আগে ইত্যাদি নানা বিষয়ে সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গসহ বিভিন্ন মহলের বক্তব্য বিবৃতির মাধ্যমে তা নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করার ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করছি। দুঃখজনক হলেও সত্য এসব নিয়ন্ত্রণে সরকারের ভুমিকা মানুষকে হতাশ করেছে।
পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা এবং মেজিস্ট্রেসি ক্ষমতা সম্পন্ন সামরিক বাহিনীর দায়িত্ব পালন নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। একই সাথে সরকারের ভূমিকাও জনমনে প্রশ্নবিদ্ধ। মব ভায়লেন্স শুধু আইন শৃঙ্খলার পরিবেশ বিনষ্ট করে তা নয় মানুষের মধ্যে যুক্তিহীন শক্তি প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা তৈরি করে। ইতিমধ্যে মাজার ধ্বংস, সরকারি স্থাপনা, পরাজিত প্রতিপক্ষের বাড়িঘর ধ্বংস, নারীদের খেলা বন্ধ, বাউলদের অনুষ্ঠান বন্ধ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জোর করে পদত্যাগ করানো, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞান, দর্শন ও ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের নাম পরিবর্তন এর পাশাপাশি সভা সমাবেশ বন্ধে পুলিশি নিপীড়ন,বিচার বহির্ভূত হত্যা,সরকারী হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা মানুষের মনে শঙ্কা ও ক্ষোভের জন্ম দিচ্ছে যা গণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্যে মারাত্মক হুমকি। গণহত্যাকারীদের বিচার,নিহত-আহতদের ক্ষতিপূরণ-পুনর্বাসন,দ্রব্যমূল্য ওআইন শৃংখলা পরিস্হিতি নিয়ন্ত্রণসহ জনজীবনে শান্তি-স্বস্তি প্রতিষ্ঠায় সরকারের দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। একই সাথে পতিত স্বৈরচার ও তার দেশি-বিদেশি দোসরদের নানা চক্রান্ত ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় সকলকে সংগ্রাম জারী রাখা জরুরি।
আমরা মনে করি অন্তরবর্তীকালীন সরকারের ৬ মাসের কার্যক্রম নিয়ে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতার একটি চিত্র জনগণের সামনে উন্মোচিত হবে এবং কি করণীয় সে সম্পর্কে একটি পথ রেখা তৈরি করা সম্ভব হবে। অন্তরবর্তীকালীন সরকার গঠিত সংস্কার কমিশনসমূহের সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর যেমন মতামত দেয়া প্রয়োজন, তেমনি এ বিষয়ে দেশের জনগণেরও বিপুল আগ্রহ আছে। সুপারিশসমূহ সম্পর্কে আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি তাতে মনে হয়েছে এসব নিয়ে ব্যাপক ও বিস্তৃত আলোচনা করা প্রয়োজন।
সংস্কার সুপারিশগুলো স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ধরে নিয়ে কিছু সংস্কার যেমন দ্রুত করা দরকার কিছু সংস্কার তেমনি দীর্ঘসময় ধরেও করতে হবে। কিছু সুপারিশ গ্রহণযোগ্য, কিছু নিয়ে বিতর্ক হবে আবার কিছু সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে বিরোধ হতে পারে বলে আমাদের ধারণা। ফলে ঐকমত্য তৈরি করতে আলোচনার সুযোগ এবং সময় প্রয়োজন হবে। তবে সংস্কারের আলোচনার পাশাপাশি যুক্তিসংগত সময়ে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে দ্রুত নির্বাচনের আয়োজনের উদ্যোগও একইসাথে নিতে হবে। এ জন্যে প্রতিটি দলকে সুপারিশ সমূহের কপি সরবরাহ করা এবং মতামত প্রদানের সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয়া দরকার। এই জটিল এবং সময়সাধ্য কাজ সৌজন্যমূলক বৈঠকে সম্পন্ন করা যাবে না তবে এই বৈঠক একটা সূচনা হতে পারে।
আমরা মনে করি প্রতিটি রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরেও এই সুপারিশগুলো নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। প্রতিটি দলের কাছ থেকে লিখিত মতামত নেয়া হলে তাতে আলোচনাকে সুনির্দিষ্ট ও যথাযথ করা সম্ভব হবে। আমরা সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোতে উল্লেখিত সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েই আমাদের মতামত প্রদান করতে চাই। ভবিষ্যতে সে সুযোগ আমরা পাব, এই প্রত্যাশা করি।